ডেস্ক রিপোর্ট: করোনা নিয়ে সবাই এই মুহূর্তে আতঙ্কগ্রস্ত। কিন্তু অতীতে একটু চোখ বোলালেই দেখা যাবে, মহামারি কোনও নতুন বিষয় নয়। গত কয়েক বছরে সেভাবে তার দেখা পাওয়া যায়নি বলে মানুষ তাকে ভুলে গিয়েছিল, এই যা। কিন্তু মহামারি ভাল করে বুঝিয়েছে, শিখিয়েছে, স্বাস্থ্যবিধি অবহেলা করলে কী হয়, প্রকৃতিকে অবহেলা করলে কী হয়। তারপর কখনও নিজের খেয়ালে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। কখনও বা এসেছে ঘুরে ঘুরে। প্রচুর প্রাণ নিয়ে এক সময় বিদায় নিয়েছে। করোনা পর্বে প্রবেশের আগে, আসুন অতীতের মহামারীর সঙ্গে একটু পরিচয় করে নেওয়া যাক। ফলে অতীতের মহামারি থেকে কী শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে, সে সম্পর্কে আঁচ পাওয়া যাবে।
প্লেগ
প্লেগের সঙ্গে বাঙালির পরিচয় সাহিত্যের মাধ্যমে। কিন্তু এর উদ্ভব আরও অনেক অনেক আগে। প্রথম বার আনুমানিক ৪৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিসে প্লেগের আবির্ভাব ঘটে। ছারখার করে দেয় এথেন্সকে। তিরিশ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায় এতে। তবে এই মহামারির কারণ প্লেগই ছিল, না অন্য কিছু তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ আছে।
দ্বিতীয়বার ৫৪০-৪১ খ্রিস্টাব্দে। সে সময়ে রোমে রাজত্ব করছেন সম্রাট জাস্টিনিয়ান। বাইজানটিয়াম সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপলে রোগের সূত্রপাত হয়। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে গোটা ইউরোপে। ইঁদুর থেকে মাছির মাধ্যমে ছড়ায় এই রোগ। এক শস্যবাহী জাহাজে চড়ে মিশর থেকে প্লেগ পৌছায় বাইজান্টিয়ামে। সেখান থেকে সারা ইউরোপে। কেন, কী হচ্ছে, তা বুঝতে বুঝতে শুরু হয়ে যায় মৃত্যু। দিনে প্রায় ৫০০০ মানুষ মারা যেতে থাকে। ইউরোপের জনসংখ্যা অর্ধেক করে দিয়ে বিদায় নেয় প্লেগ। মারা যায় ১০ কোটি মানুষ।
প্লেগের তৃতীয় ভয়াবহ রূপ দেখা যায় ১৮৬০ সালে। কোভিড-১৯ এর উৎপত্তিস্থল চিনের উহানে শুরু হয়ে দেশের প্রধান শহরগুলির মধ্যে দিয়ে তা বেশ কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে প্লেগ। প্রায় দু-দশক ধরে চলে এই মহামারি। ১৮৯০ সালে প্রতিষেধক আবিস্কারের পর এর প্রকোপ কমতে থাকে। তবে প্রতিষেধক বের হওয়ার আগেই প্রায় দেড় কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। বিপদ আসে আবার। ১৯১০ সাল নাগাদ চিনের মাঞ্চুরিয়ায় আবার মহামারি হয়। মাত্র দু’বছরে মারা যায় ষাট হাজার মানুষ।
স্মল পক্স, ইয়োলো ফিভার, পোলিও

স্মল পক্সও ঠিক প্লেগের মতো ভয়াবহ হতে শুরু করে। ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে মেক্সিকোতে দু’বছরে প্রায় আশি লক্ষ মানুষ মারা যায়। ১৬৩৩ সালে ম্যাসাচুসেটসে রোগটি আবার ছড়িয়ে পড়ে। মারা যায় প্রায় দুকোটি মানুষ। আঠারো শতকের শেষ ভাগে পক্সের টিকা বের হয়।
১৭৯৩ সালে ফিলাডেলফিয়ায় ইয়োলো ফিভারে মারা যান প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ।
১৯১৬-তে হয় পোলিও মহামারি। মারা যান লক্ষ লক্ষ মানুষ। বিশ শতকের মাঝামাঝি পোলিও-র টিকা আবিষ্কার হওয়ার পরে অনেক দেশই পোলিওমুক্ত হতে পেরেছে।
স্প্যানিশ ফ্লু
নামে স্প্যানিশ ফ্লু হলেও এই রোগের সূত্রপাত কিন্তু স্পেনে হয়নি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, ইংল্যান্ড হয়ে সে স্পেনে পৌঁছায়। আক্রান্ত হন স্পেনের রাজ পরিবারের সদস্যরা ও আরও অনেক বিশিষ্ট মানুষ। সে সব খবর বেশ ফলাও করে বাইরে আসতে থাকায় মানুষ ভাবেন, রোগটি বুঝি স্পেন থেকেই ছড়িয়েছে।
১৯১৮-১৯২০ সালের মধ্যেই পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে গ্রাস করে নেয় এই মহামারি, মারা যান কোটি কোটি মানুষ, কম করে ৫-১০ কোটি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যত মানুষ মারা গিয়েছিলেন, তার চেয়েও বেশি সংখ্যক মানুষ মারা যান এইচ১এন১ ভাইরাসের এই মারাত্মক প্রজাতির আক্রমণে।
তৎকালীন ভারতবর্ষেও এক ব্যাপার। সরকারি হিসেবে ১.৭-১.৮ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিলেন ভারতবর্ষে। এই মহামারিতে মহিলারা আক্রান্ত হয়েছিলেন বেশি। কারণ তাঁরা অপুষ্টি ও রক্তাল্পতায় ভুগতেন। বদ্ধ, অস্বাস্থ্যকর ঘরে কাটাতেন দিনের বেশির ভাগ সময়। তাঁর উপর তাঁদের হাতেই ছিল রোগীর সেবার ভার। ফলে বাড়ির পুরুষটি যদি বা সুস্থ হয়েছেন, মহিলারা মারা গিয়োছেন নির্বিচারে। সঙ্গে কমবয়সিরাও। ভাগ্যের ফেরে এই সময়ই শুরু হয় ভয়াবহ খরা। গ্রাম থেকে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষ দলে দলে আসতে থাকেন শহরে। পরিণতি কী হয়, সহজেই অনুমেয়।
তাহলে করনীয়?
যে সময় ভাইরাস মারার ওষুধ তো দূরস্থান, অ্যান্টিবায়োটিক পর্যন্ত ছিল না, ভেন্টিলেটর তো দূরস্থান, গুরুতর রোগীর চিকিৎসার সাধারণ সরঞ্জামও কিছু ছিল না, সে সময় নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনেই মানুষ প্রাণে বেঁচেছে, বহু মানুষের রোগ ঠেকানো গিয়েছে।
তা হলে আজকের এই উন্নত প্রযুক্তির মাঝে থেকে, যেখানে সরাসরি ভাইরাস মারার ওষুধ না থাকলেও, ভাইরাসের প্রভাবে যা যা ক্ষতি হয়, তাকে সামলানোর ব্যবস্থা আছে, সেখানে আশ্বস্ত থাকার কারণ যথেষ্ট।
সবচেয়ে বড় কথা, অন্য রোগগুলির তুলনায় কোভিড অত মারাত্মক নয়। প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ সংক্রমিত হওয়ার পর নিজে নিজেই সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন, অনেকেই জানতেই পারছেন না এই রোগ হয়েছিল বলে, ২০ শতাংশের মধ্যে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে, তার মধ্যেও প্রায় অনেকেই সাধারণ চিকিৎসায় সুস্থ হচ্ছেন, বাকিদের জটিলতা হলেও তা সামলানো যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, মারা যান ১-৩ শতাংশ মানুষ। বেশির ভাগই বয়স্ক কিংবা অন্য কারণে গুরুতর অসুস্থ। তা হলে এত আতঙ্ক কেন? একে হারিয়ে যে আমরা জয়ী হব, এ কথা নিশ্চিত। তাই সাবধানে থাকুন, তবে আতঙ্ক নয়। শিক্ষা নিতে হবে অতীতের মহামারি থেকে।